এখনও কিছু পলাশ আছে তোমার জন্য। এখনও কিছু পলাশ থাকবে তোমার জন্য। আর কিছু পলাশ ঝরেছে, অবচেতনে তুমি সোহাগী পা ফেলে যাবে তার বুকের উপর দিয়ে, সে হবে ধন্য। কিছু পলাশ থাকবে হৃদয়ে সবদিনের জন্য।
বিশ্বাস করো শেষ বসন্তে এখনও তোমার জন্যে অপেক্ষা করে আছে পলাশের দল মুরাডির মাঠে-ঘাটে। ভেটির অগোছালো অরণ্যে মাটি রাঙা করে ঝরে আছে তোমার পা ছুঁয়ে শিব হবে বলে। জানোই তো যা সত্য তাই শিব আর সুন্দর। আর গড়ের ভাঙা ইতিহাসকে দেখে করুণায় উদ্বেলিত হবার সময় চোখ চলে যাবে সামনের পলাশ ঘেরা ছোট কাকচক্ষু জলাশয়ের দিকে, আয়না স্থির জলে লাল আগুনে প্রতিবিম্ব। উপরে পাহাড়ে সবুজে আগুন লেগেছে কোণে কোণে। এর পরেও বাকি রইল গড় থেকে পাঞ্চেতের রাস্তা নিয়মিত যত্ন নেওয়া চকচকে চামড়ার মতো মাখন রাস্তার দু’পাশে পলাশের রঙে বসন্তের মাতাল করা হোলি খেলা।
এতক্ষণে নিশ্চয়ই বুঝে গেছ, কোন ধান ভানতে কোন শিবের গীত গাওয়া হচ্ছে অর্থাৎ পলাশের অরণ্য দেখতে কোথায় যাওয়া হচ্ছে। হ্যাঁ গো, পুরুলিয়ার বড়ন্তি। লেক, পাহাড় আর পলাশের জঙ্গলে বড়ন্তি বড়ই সুন্দর, ঠিক যেন পটে আঁকা ছবিটি।
একদিন সকালে বেরিয়ে চলো বড়ন্তির পথে। আসানসোল থেকে মুরাডি যাওয়ার ট্রেন ধরবে। আধ ঘণ্টায় পৌঁছে যাবে চারটে মাত্র স্টেশন পরেই, ট্রেনও অনেক। মুরাডি স্টেশনে নেমে টোটো করে পাঁচ কিলোমিটারের মধ্যে বড়ন্তি লেকের ধারে পৌঁছে পা দোলাতে পারবে।
বড়ন্তি পৌঁছে তোমার প্রথম কাজ কী হবে সেটা নির্ভর করছে কখন পৌঁছলে তার উপর। দুপুরে গেলে, প্রথম কাজ বিকেলে লেকের জলে সূর্যাস্ত দেখা। অস্তগামী সূর্য তার মুখ দেখে বাঁধের জলের আয়নায়। তিরতির কাঁপা জলে লাল টিপটাতেও মৃদু কম্পন। শেষ বিকেলের সূর্য শুনি নিজেই একটা প্রতিবিম্ব, সেও আবার বিম্বিত হয় জলের মুকুরে।
খুব সকালে তিন কিলোমিটার দূরে ভেটি গ্রামে যাব পলাশের মেলা দেখতে। কমলা ঘেঁষা আগুন-লাল এই বসন্ত মাতাচ্ছে। বাচ্চারা পলাশের মালা বিক্রি করছে, শৈশব বিক্রি হচ্ছে অভাবের রূপকথায়। ভেটি ঘুরে যাব গড় পঞ্চকোট। এই অংশটুকুর জন্য গাড়ি হলে ভাল, নিজের নাহলে হোটেলের ব্যবস্থায়। সুভাষ মোড় থেকে পুরুলিয়ার দিকে সামান্য গিয়ে রেল লাইনের পর ডানদিকের রাস্তায় গড় পঞ্চকোট। ভাঙা গড়ের অবশিষ্টাংশ, পুরোনো রাসমন্দির, উল্টানো ইতিহাসের পাতা, মনকেমন করা এক ন্যাপথলিন মাখা অতীতের গন্ধ। গড়ের মাঠে বিশাল চারুলতা রিসর্ট, পাশ দিয়ে পাহাড়ে ওঠার পাথুরে পথ, মন্দির নির্দেশক তিরচিহ্ন অনুসরণ করে। উপরে দুর্গের ভাঙা অংশ, ভাঙা দেবতা বিহীন রঘুনাথ মন্দির। ইতিউতি পাথরের স্তূপ, সাপের খোলস।
পঞ্চকোট রাজবংশ মানভূম-পুরুলিয়ার প্রাচীন রাজবংশ। প্রায় দুহাজার বছর আগে ঝালদায় এই রাজবংশ প্রতিষ্ঠা হয়। মানভূমের সভ্যতা সৃষ্টিতে এই রাজবংশ অন্যতম প্রধান ভূমিকা নিয়েছিলেন। একবছর খাজনা ঠিক সময়ে না পৌঁছানোয় ইংরেজ রাজ্য নিলাম করার সিদ্ধান্ত নিলে পঞ্চকোটের প্রজারা ঘোষণা করেন, ‘পঞ্চকোট রাজ ছাড়া, আর কাউকে খাজনা দেব না’। শেষ পর্যন্ত কোম্পানি নিলাম রদ করে পঞ্চকোট রাজকে তাঁর রাজ্য ফেরত দেয়। জয় হয় পঞ্চকোটের প্রজাদের । ইতিহাসে এ ঘটনা চুয়াড় বিদ্রোহের দ্বিতীয় পর্যায়ের ঘটনা হিসাবে খ্যাত। সিপাহি বিদ্রোহে যোগ দেওয়ার অভিযোগে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি পঞ্চকোটের মহারাজা নীলমণি সিংহদেওকে জেলে বন্দি করেছিল। কলকাতার আলিপুরে বন্দি ছিলেন তিনি। অনেক জনপদ পঞ্চকোট রাজবংশের সৃষ্টি। জনপদ সৃজন, জাতি ও জনজাতির পৃষ্ঠপোষণও সভ্যতার প্রধানতম উপাদান। এমনই সব অলঙ্কার পঞ্চকোট রাজবংশের ভূষণ।
নিচে নেমে পার্কিং থেকে গাড়ি এগোবে চকচকে পিচ রাস্তা ধরে, পাহাড়টাকে ডান হাতে রেখে। পলাশের আগুন ধরা জঙ্গল, সাথে রুদ্র পলাশ লাল হয়ে আছে পথের পাশে। এই লাল ষাঁড়ের রক্ত নয়, আগুনের ঝাঁজের উগ্র লাল রং। রাস্তার ধারে দুটো বড় থাকার হোটেল। কালো চকচকে পিচ রাস্তা জঙ্গলের বাঁকে হারিয়ে যায় অনায়াসেই। সেই পথে এগারো কিলোমিটার গেলেই বাঁদিকে অনন্ত জলরাশি আকাশের নীল মেখে ঝিম মেরে পড়ে থাকে আর পাহাড়ের কালো ছায়া পড়ে তার একপাশে। প্রথম গরমের সূর্য তখন ভরা যৌবন তেজে মধ্যগগনে গনগনে। অনন্ত জলরাশি চোখকে দেয় শীতল আরাম। চিরকুণ্ডার দিকে গাড়ি খানিক চললে জলের সাথে ভাব হবে গভীর। বাঁধের শেষে গাড়ি ঘুরিয়ে আবার জলকে ডানদিকে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখা। এই অতল জলের পোশাকি নাম পাঞ্চেত ড্যাম। পাঞ্চেত পাহাড়ের কোলে, ঝাড়খণ্ড পশ্চিমবঙ্গের সীমারেখায় দামোদরকে বেঁধে রেখে তাকে লোকসেবায় লাগানো হয়েছে নানা ভাবে।
গাড়ি ফিরছে বড়ন্তির পথে, রোদের তাপ জানান দেবে একটু দেরি করে ফেলেছ আসতে। তাই এ-যাত্রায় জয়চণ্ডী আর নয়। এবার ফেরার পালা। তবে আর দেরি নয়, একদিনের ছুটিতেই চলো বড়ন্তি, মনে রেখো এখনও অনেক পলাশ ফুটে আছে শুধু তোমার জন্যে।
কীভাবে যাবেন?
আসানসোল থেকে ট্রেনে মুরাডি। সেখান থেকে টোটোতে বড়ন্তি লেক পাঁচ কিলোমিটারের মধ্যে।
গাড়ি : এন-এইচ-১৯ ধরে আসানসোল যাওয়া। তারপর নিয়ামতপুর মোড় হয়ে দিসেরগড় ব্রিজ পেরিয়ে পুরুলিয়ার দিকে সরবরি মোড়, তারপর আসবে সুভাষ মোড় হয়ে বামদিকে মুরাডি স্টেশনের পাশে রেলগেট পেরিয়ে বড়ন্তি লেক।
কোথায় থাকবেন?
হোটেলের গাদা। অ্যালিওর ডি বড়ন্তি, বড়ন্তি ইকো ট্যুরিজম, মহুল বন ইকো রিসোর্ট, গ্রিন ভিউ, পলাশকুঞ্জ ছাড়াও বাঁধের অন্য দিকেও অনেক হোটেল আছে। সব ক’টার ফোন নম্বর নেট থেকেই পাওয়া যাবে। রেট মোটামুটি দেড় দু-হাজারের মধ্যে। সাধারণ বাঙালি খাবার সর্বত্র। দেশি চাইনিজও সুলভ। রাস্তার ধারের হোটেলগুলোয় কেতা কম হলেও আন্তরিকতার অভাব নেই।